কর্মবাদ ও পুনর্জন্মবাদ
আমরা জীবনে যে সমস্ত অভিজ্ঞতা লাভ করি, সেগুলো কেন আমাদের কাছে এল বা আসে — এ প্রশ্নের বিভিন্ন ভাবে দেওয়া যেসমস্ত উত্তর আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম বা আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে পাই, কর্মবাদ তাদের মধ্যে একটি।
কর্মবাদ বলছে, আমরা যে সমস্ত কর্ম করি শরীর বা মন দিয়ে, তাদের স্থূল প্রকাশ কিছু সময় পরে শেষ হয়ে গেলেও, তাদের প্রত্যেকটিরই একটা সূক্ষ্ম প্রকাশ বা অনুরণন থেকে যায় আমাদের মনে, যাকে বলা হয় ‘সংস্কার’। এই সংস্কার ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা রূপেই আমাদের কাছে প্রকাশ পায়। অতীতে কৃত কোনো কর্ম থেকে জাত সংস্কার যখন ভবিষ্যতে এরকম অভিজ্ঞতার রূপ নিয়ে আসে, সেই অভিজ্ঞতাকে বলা হয় কর্মফল।
কর্মবাদ অনুসারে আমরা যাই করি না কেন, তারই একটা সূক্ষ্ম প্রকাশ ভবিষ্যতে অভিজ্ঞতারূপে আসবে। তাই যদি হয়, তাহলে বর্তমানে আমাদের যে সমস্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সেগুলো নিশ্চয়ই অতীতে কৃত আমাদের নিজেদের কর্মেরই ফল হিসাবে আসছে। একথা শুধু কিছু বর্তমান অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রেই নয়, সমস্ত বর্তমান অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কারণ কর্মবাদ অনুসারে আমার কৃত কর্ম আমার ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতা হিসেবেই আসবে, অন্যের ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতা হিসেবে নয়। তাই কিছু অভিজ্ঞতা আমার কর্মের জন্য আসছে আর কিছু অন্যের কর্মের জন্য, তা হতে পারে না। সমস্ত অভিজ্ঞতাই আমারই কর্মের জন্য আসছে, অন্য কেউই দায়ী নয়। এই হচ্ছে কর্মবাদের ভাবে জীবনের অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা।
আছে। কর্মবাদ আর বিজ্ঞানে আলোচ্য কার্য-কারণ সম্বন্ধ এই দুটিই একই মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা হল — কার্য-কারণ সম্বন্ধ (causality)। উল্লেখযোগ্য যে এখানে ‘কার্য-কারণ সম্বন্ধ’ এবং ‘বিজ্ঞানে আলোচ্য কার্য-কারণ সম্বন্ধ’ - এ দুটোর মধ্যে একটু তফাৎ করা হল। এই তফাৎটা বুঝলেই বোঝা যাবে কর্মবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধিতা নেই, শুধু এই যে কর্মবাদের দৃষ্টি ও প্রসার বর্তমান বিজ্ঞানের চেয়ে আরো অনেক গভীরে। গত একশো বছরে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ঘটলেও, এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানে যে কার্য-কারণ সম্বন্ধ আলোচিত হয়, তা মূলতঃ ভৌতিক বা দৈহিক (physical)। কিন্তু মানসিক স্তরে কার্য-কারণ সম্পর্ক কতো বিস্তৃতভাবে প্রযোজ্য হতে পারে সে বিষয়ে বিজ্ঞানের ধারণা এখনও যথেষ্ট সীমিত। কিসের তুলনায় সীমিত? প্রকৃত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের তুলনায়। গত কয়েক দশকে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গভীর চিন্তা দেখা গেলেও, এখনও পর্যন্ত মূলধারার বিজ্ঞানে মনকে দেহের থেকে আলাদাভাবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কর্মবাদ আর কিছুই নয়, এই মানসিক স্তরে কার্য-কারণ সম্বন্ধের প্রয়োগ। এই প্রয়োগের পেছনে আছে মন সম্পর্কে অতি গভীর বোধ।
ধরা যাক, আমি একজন লোককে মারলাম। আমার নিজের কথা চিন্তা করা যাক। আমার নিজের হাতেও হয়তো চোট লাগল মারতে গিয়ে। তাতে একটু রক্তও পড়ল। তাতে একটু ব্যাথাও পেলাম। বিজ্ঞান এখানে বলতে পারবে কেন রক্ত পড়ল। আমার শরীরে কার্য-কারণ সম্পর্ক কাজ করে কীভাবে রক্তপাত ঘটাল, বিজ্ঞান তা মোটামুটি ব্যাখ্যা করতে পারবে। এবার আর একটু এগোনো যাক। আমি নিজে যে ব্যাথা অনুভব করলাম, সেই ব্যাথার অভিজ্ঞতার কারণটা কি? ব্যাথা তো নাও লাগতে পারত। অনেক সময় মশা আমাদের শরীরে বসে রক্ত খেলেও আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু করলে সঙ্গে সঙ্গে টের পাই না। তাহলে এক্ষেত্রে লাগল কেন? লক্ষ্য করে বোঝার বিষয় যে রক্তপাতের কারণ আর আমার ব্যাথার অভিজ্ঞতার কারণ কিন্তু এক নয়। রক্তপাতটা দেহে, কিন্তু ব্যাথাটা মনে। মনটা রক্তপাতের স্থানের সাথে সংযুক্ত যে স্নায়ুকেন্দ্র তার সাথে সংযুক্ত ছিল, তাই ব্যাথার অভিজ্ঞতাটা হল। তবে বিজ্ঞান এখনও মনকে দেহ থেকে আলাদাভাবে দেখে না। তাই বিজ্ঞান ঐ স্নায়ুকেন্দ্র বা তৎসংলগ্ন শিরা-উপশিরায় রক্তচলাচলের পরিবর্তনকেই ব্যাথার অভিজ্ঞতার কারণ হিসেবে বলবে। ঐ পরিবর্তন fMRI scan এ দেখা যাবে। ঠিক যেরকম ভাবে কারোর বুকে ব্যাথা হলে বিজ্ঞান ECG যন্ত্র দিয়ে হৃদকম্পনের মাত্রার পরিবর্তন মাপতে পারে। আমরা জোর করে ধরে নিলাম যে, এভাবে বিজ্ঞান আমার ব্যাথার অভিজ্ঞতাটাকেও একরকম করে ব্যাখ্যা করতে পারছে। কিন্তু রক্তপাত এবং আমার তাৎক্ষণিক ব্যাথার অভিজ্ঞতা ছাড়াও, আমার কৃত কর্মের আর একটা সূক্ষ্ম প্রভাব বা অনুরণন আমার মনের গভীর স্তরে অবস্থান করবে। এই ব্যাপারে বিজ্ঞান সাধারণভাবে এখনও অজ্ঞ। আর এই স্তরেই কর্মবাদের দৃষ্টি। কর্মবাদ দেহের বা মনের তাৎক্ষণিক বা বাহ্যিক স্তর নিয়ে আলোচনা করে না। কর্মবাদ সমস্ত কর্মের সূক্ষ্মতর স্তর যা মনের গভীরে থেকে যায় সংস্কার হিসাবে, তা নিয়ে আলোচনা করে। এই হচ্ছে বিজ্ঞানের সাথে কর্মবাদের কার্য-কারণ সম্বন্ধের পার্থক্য।
সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর কার্য সঙ্গে সঙ্গে আসে না, ভবিষ্যতে আসে। তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা হিসাবে আসে না, সুদূরপ্রসারী অভিজ্ঞতা হিসাবে আসে। তবে তাই শুধু নয়, সংস্কার কর্মের সূক্ষতর অনুরণন বলে তার ভেদন-ক্ষমতা বেশি হয়, তা মনের গভীরতর অংশে প্রবেশ করতে পারে ও মনকে সেই স্তর থেকে পরিবর্তিত করতে পারে, যা তাৎক্ষণিক প্রভাব পারে না। তাই বেশ কিছুকাল যাবৎ যত্ন করে প্রকৃত সংস্কার তৈরী করতে পারলে তার জোরে অনেক উচ্চ অভিজ্ঞতালাভ সম্ভব, যা তাৎক্ষণিক প্রভাবের দ্বারা সম্ভব নয়।
ভারতীয় দর্শন, বিশেষতঃ বেদান্তের পরিভাষায়, প্রত্যেকটি জীব তিনটি শরীরের সমন্বয়ে গঠিত। জীবের প্রকৃত স্বরূপ অর্থাৎ আমরা আসলে যা তা হলো বিশুদ্ধ চৈতন্য (pure consciousness), যা এই তিনটি শরীরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। এই তিনটি শরীর হল – স্থূল শরীর, সূক্ষ্ম শরীর ও কারণ শরীর। এদের মধ্যে স্থূল শরীর হলো আমরা যাকে দেহ বলি তা। এখানে দেহ বলতে শুধু দেহের বাইরের অংশ নয় ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বোঝাচ্ছে। হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, শিরা-উপশিরা, স্নায়ু সবই স্থূল শরীরের অন্তর্গত। সূক্ষ্ম শরীর হচ্ছে সেই স্তর যেখানে প্রাণশক্তি ও মানসিক বৃত্তিসমূহ যেমন চিন্তা, স্মৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি এদের অবস্থান। সংস্কার এই সূক্ষ্মশরীরেই অবস্থান করে। তবে সূক্ষ্মশরীরের গভীরতর অংশে।
পুনর্জন্মবাদ আর কিছুই না, কর্মবাদেরই স্বাভাবিক প্রসারণ। কর্মবাদ অনুযায়ী কর্মজাত সংস্কার ভবিষ্যতে অভিজ্ঞতারূপে ফল দেবে। এখন কেউ যদি সেই ফল পাবার আগেই মারা যায় তাহলে কি হবে? মারা গেলে তার আবার অভিজ্ঞতা কী করে হবে? কিন্তু কার্য-কারণ নীতি অনুযায়ী কারণের মধ্যে যে শক্তি ছিল, সেই শক্তি তো নষ্ট হতে পারে না। কাজেই সেই সংস্কাররূপী কারণের কার্য উৎপন্ন হবেই যে কোনো ভাবে হক। আবার সেই কার্য নিজের অভিজ্ঞতারূপেই আসতে হবে, অন্যের অভিজ্ঞতায় আসতে পারে না। তাই কর্মবাদ বজায় রাখতে, ঐ ব্যক্তির জীবাত্মা ভবিষ্যতে অন্য দেহ-মনের মাধ্যমে প্রতিভাত হতে বাধ্য, এবং সেই দেহ-মনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সংস্কারের ফললাভ হবে। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত সংস্কার থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু হলেও জীবের আবার জন্ম নিশ্চিত। সেই সংস্কারই স্থূল ও সূক্ষ্ম প্রকৃতির নিয়মে নতুন দেহ-মন গঠন করবে। কাজেই, কর্মবাদ আর পুনর্জন্মবাদ একই ধারণার বিভিন্ন অংশ।
সংস্কার যদি সূক্ষ্মশরীরে অবস্থিত থাকে, আর মৃত্যুর পরে যদি সেই সংস্কারের জন্য আবার জন্ম হয়, তবে বোঝাই যাচ্ছে যে মৃত্যুতে সূক্ষ্মশরীরের ধ্বংস হয় না, কারণ তাহলে সংস্কারগুলোও ধ্বংস হয়ে যেত। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যাকে মৃত্যু বলি, তাতে শুধুই স্থূল শরীরটা ধ্বংস হয়, সূক্ষ্মশরীর ধ্বংস হয় না। সূক্ষ্মশরীর শুধু স্থূলশরীর থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেয়, যাতে স্থূল শরীর নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সূক্ষ্মশরীরের অন্তর্গত সমস্ত সংস্কার সূক্ষ্ম প্রকৃতিতে বর্তমান থাকে, যা অনুসারে ভবিষ্যতে আবার স্থূলশরীর গঠিত হয় স্থূলপ্রকৃতির উপাদান নিয়ে। একেই আমরা বলি জন্ম। কাজেই জন্ম ও মৃত্যু দুটোই স্থূলশরীরের, সূক্ষ্মশরীরের নয়; আর আত্মার তো নয়ই। আমাদের স্থূল শরীর মাত্র কয়েক বছরের পুরোনো; কিন্তু আমাদের সূক্ষ্মশরীর অতি অতি প্রাচীন।
বিভিন্ন জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কর্ম ও কর্মফল বা অভিজ্ঞতা রূপে যে একই কার্য-কারণ সম্বন্ধ বয়ে চলেছে, একেই বলা হয় কর্ম-পরম্পরা। আলোচনার সুবিধার্থে এই কর্ম-পরম্পরাকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই চারটি ভাগ হল – সঞ্চিত কর্ম, প্রারব্ধ কর্ম, ক্রিয়মান কর্ম ও আগামী কর্ম। আমাদের প্রত্যেকের সূক্ষ্মশরীরে আগের বহু বহু জন্মের যেসমস্ত সংস্কার জমে আছে, তাদেরকে একত্রে বলে সঞ্চিত কর্ম। এই সমস্ত সঞ্চিত কর্ম মাত্র একই জন্মে ফল দিতে পারে না। কেউ যখন মারা যায়, তখন সূক্ষ্মপ্রকৃতির নিয়মে তার সেই সময় পর্যন্ত সঞ্চিত কর্মের একটা অংশমাত্র পরবর্তী জন্মে ফল দেবার জন্য উদ্যত হয়। এই অংশকে বলে প্রারব্ধ কর্ম। প্রারব্ধ মানে যা বিশেষভাবে আরম্ভ হয়ে গেছে, অর্থাৎ যে সমস্ত সংস্কার ফলপ্রসূ হয়ে পড়েছে। এই প্রারব্ধ কর্ম অনুসারেই আমাদের জন্ম হয়। এই জন্মে দেহ ও মন কিরকম হবে, বিশেষ কি দোষ-গুণ থাকবে, কোন পরিবেশে কোন পরিস্থিতিতে জন্ম হবে, জীবনে সুখ-দুঃখের কি কি বিশেষ অভিজ্ঞতা আসবে এবং কখন এই জন্মে দেহের মৃত্যু হবে – এ সবই ঠিক হয় প্রারব্ধ কর্মের ফললাভের উপযোগী হিসাবে। এখন বর্তমান জন্মে আমরা শুধু যে পূর্বকৃত কর্মের ফলভোগ করছি অভিজ্ঞতা হিসাবে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে নতুন কর্মও করছি। একেই বলে ক্রিয়মান কর্ম। আর এই ক্রিয়মান কর্মের যে ফল এখন সংস্কাররূপে জমছে এবং ভবিষ্যতে অভিজ্ঞতারূপে আসবে, তার নাম আগামী কর্ম।
বোঝাই যাচ্ছে, সঞ্চিত কর্ম আর প্রারব্ধ কর্মের ওপর বর্তমানে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই অতীতকে সরাসরি পরিবর্তন করা যাবে না। কি ভাবে করা যাবে? ক্রিয়মান কর্ম আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন; তাই একমাত্র ক্রিয়মান কর্মের মাধ্যমেই আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করতে পারব। ক্রিয়মান কর্মের সঠিক অনুশীলনের দ্বারা প্রারব্ধ কর্মের প্রকোপকেও কমানো সম্ভব।
ধরা যাক একজন লোক আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধাপ্পা দিয়ে চলে গেল। এতে আমার যে তাৎক্ষণিক খারাপ লাগার অনুভূতিটা হল, অর্থাৎ যে দুঃখভোগটা হল, কর্মবাদ অনুসারে সেটা প্রারব্ধ কর্ম, আমারই পূর্বকৃত কর্মের ফল। প্রারব্ধ কর্ম অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ফল দিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আর সে থাকল না। কিন্তু আমি এই অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অসম্ভব রেগে গিয়ে কাউকে একটা খারাপ কিছু বলে বসলাম। এটা কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম নয়, এটা আমার ক্রিয়মান কর্ম। এবং এর ফল আমাকে ভবিষ্যতে পেতে হবে।
কর্মবাদ অনুসারে, আমাদের এই জন্মের সমস্ত অভিজ্ঞতার এক অংশ প্রারব্ধ কর্ম থেকে আসছে, আর এক অংশ এই জন্মেই কৃত ক্রিয়মান কর্মের সংস্কার থেকে আসছে।দ্বিতীয় অংশের অভিজ্ঞতা যদি হয়, তাহলে জীবনে কোনো কোনো সময়ে আমরা হয়তো কিছুটা বুঝতে পারি, একটা মোটামুটি স্পষ্ট বোধ কাজ করে যে ঠিক কি করেছিলাম বলে এই অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এমন নয় যে জীবনে সমস্ত অভিজ্ঞতাই আসে একেবারে হতবাক করে দিয়ে; লোকে অন্যের কাছে যাই বলুক না কেন, নিজের অন্তরে এটা অস্বীকার করতে পারবে না; তবে অবশ্যই সব সময় নয়। এই বোধ সম্ভব হয় আমাদের এই জন্মে কৃত কর্মের স্মৃতি সচেতন মনে আছে বলে। কিন্তু প্রথম অংশের অভিজ্ঞতা, অর্থাৎ আগের কোনো জন্মে কৃত কর্মের ফল যদি এই জন্মে লাভ হয়, তাহলে কোন কর্ম থেকে তা এসছে সেটা বোঝা একপ্রকার অসম্ভব সাধারণ মানুষের পক্ষে, কারণ গত জন্মের কোনো স্মৃতি এই জন্মের সচেতন মনে নেই। বোঝা যে একেবারেই যায় নয় তা নয়। যোগীরা বলেন বোঝা যায়, কিন্তু তা বুঝতে মনের যে শক্তির প্রয়োজন তা সাধারণ মানুষের নেই; যথেষ্ট সাধনার দ্বারা সেই শক্তি অর্জন করলে বোঝা যেতে পারে। তবে জীবনে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করার পর এটা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে সব কিছু এই জন্মের চেষ্টা বা চেষ্টাহীনতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
কর্ম করলে তার সংস্কার পড়ে মনে। কর্ম ভালো হলে সংস্কারও ভালো হবে। কিন্তু কর্ম ভালো কখন বলব? কর্ম ভালো তখনই যখন যে উদ্দেশ্য (motive) নিয়ে সেই কর্ম করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যটা ভালো। বাইরে আমি কি করছি সেটা বড়ো ব্যাপার নয়, কি ভাবনা নিয়ে সেটা করছি সেটাই বড়ো ব্যাপার, আর সেটাই কর্মের ভালোত্বের বা মন্দত্বের মাপকাঠি। আমি হয়তো আনমনে একটা জিনিস রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সেটা হয়তো কোনো লোক কুড়িয়ে পেল ও তার অনেক উপকারে লাগল। এতে আমার কোনো ভালো কর্ম হবে না, কারণ কারোর উপকারে লাগতে পারে সেই ভাবনা নিয়ে আমি ওটা ফেলি নি। ঠিক তেমনি, আমি সত্যই কারোর ভালো করার ভাবনা নিয়ে একটা জিনিস করলাম, কিন্তু দেখা গেল তাতে তার ক্ষতি হয়ে গেল। এতে কিন্তু আমার মন্দ কর্ম হবে না, কারণ উদ্দেশ্য ভালো ছিল।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যার উত্তরটা সঠিকভাবে বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজন। আমি হয়তো ভাবলাম, যেহেতু সবার ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতা শুধুমাত্র তাদের নিজেদের কর্মের ওপর নির্ভর করে, আমি আর অন্যকে সাহায্য করার কোনো চেষ্টা করব না। যেমন রাস্তায় একজন ক্ষুধার্ত গৃহহীন ব্যক্তি হয়তো কষ্ট পাচ্ছে; কিন্তু তার কষ্টের অভিজ্ঞতা তার নিজের কর্মের জন্য, তাই আমি তাকে আর খাবার দেওয়ার কথা ভাববো না। প্রথমেই দেখতে হবে আমি এই চিন্তাটা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করছি কি না। আমার পরিবার-আত্মীয়-বন্ধুদের ক্ষেত্রেও কি আমি একইভাবে এই কথা ভাবছি? আমার কোনো আপনজন যদি রাস্তায় পড়ে ক্ষিদেতে কষ্ট পায়, তাহলেও কি আমি কর্ম ভেবে একইভাবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারব? তা যদি না পারি, তাহলে ঐ ক্ষুধার্ত গৃহহীন ব্যক্তিকে খেতে না দেওয়ার মধ্যে কর্মবাদের প্রয়োগ হচ্ছে না, শুধুমাত্র কর্মবাদের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। আমার আপনজনদের ক্ষেত্রে আমার স্পষ্ট বোধ আছে যে আমি খেতে দিলে তাদের কষ্ট লাঘব হবে। সেই বোধ থাকা সত্ত্বেও আমি যদি ঐ ক্ষুধার্ত গৃহহীন ব্যক্তির কষ্ট মেটানোর চেষ্টা না করি কোনো না কোনো ভাবে, তাহলে আমার নিজের পক্ষে সেটা খারাপ কর্ম করা হবে, যার সংস্কার আমার মনে জমা হবে। কাজেই, অন্যের কষ্ট আমি কমাতে পারি সাধারণভাবে এই বোধ থাকা সত্ত্বেও আমি যদি কমানোর চেষ্টা না করি, তাহলে আমি নিজের মন্দ সংস্কার উৎপন্ন করবো, যা আমাকেই পরে মন্দ অভিজ্ঞতা লাভ করাবে; আর কমানোর চেষ্টা যদি করি, তাহলে আমি নিজের ভালো সংস্কার উৎপন্ন করবো, যা আমাকে পরে ভালো অভিজ্ঞতা দেবে। আর যে সবার ক্ষেত্রে সমভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে কর্মবাদের প্রয়োগ করতে পারে, সে এখনই অতি উচ্চ স্তরের মহাপুরুষ।
আগের প্রশ্নে দেখলাম, অন্যের ভালো করার কোনোরকম চেষ্টা না করার মধ্যে দিয়ে কর্মবাদের সঠিক প্রয়োগ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যেভাবে সাধারণ মানুষের পক্ষে কর্মবাদের প্রয়োগ সম্ভব, সেটা এবার বোঝার চেষ্টা করা যাক। আমি অন্যের ভালো করার চেষ্টা করলাম? কিন্তু কতটা ভালো করতে পারি? কতক্ষণের জন্য করতে পারি? ধরা যাক, আমি একজন ক্ষুধার্তকে খেতে দিলাম। সেসময়ের জন্য তার ক্ষুধা মিটল। কিন্তু আমি দেখলাম পরদিন আবার ক্ষুধার্ত, আবার খেতে দিলাম। কিন্তু এভাবে চলতেই থাকল। আমি তাকে একদিন ডেকে বললাম, ভাই কাজ করো, তাহলে নিজেই উপার্জন করতে পারবে। সে হয়তো তাতে বলে বসল, না কাজ করার ইচ্ছে নেই এভাবেই চলছে চলুক। ব্যস্, আমার রাগ হয়ে গেল, তার পরদিন থেকে তাকে আর কোনো সাহায্য করার চেষ্ট করলাম না। এরকম প্রায়ই হয়। আমরা কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই, কিন্তু দেখা গেল সে আমাদের সাহায্যের কোনো মূল্যই দিলো না, কিংবা আমরা যেরকম চেয়েছিলাম, সেরকম হলো না। ফলে আমাদের মনে রাগ বা হতাশার সৃষ্টি হল। এখানেই কর্মবাদের প্রয়োগ সম্ভব, এবং দরকার। অন্যের ভালো করার চেষ্টা আমাদের করতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে অন্যের দীর্ঘকালীন ভালো আমরা করতে পারি না। আমার বিবেক-বিবেচনা অনুযায়ী আমি কারোর ভালো করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তার মানেই এই নয় যে সে আমাদের প্রত্যাশা মতই চলবে বা অভিজ্ঞতা লাভ করবে। কর্মবাদ অনুসারে সে তার নিজের সংস্কার অনুসারেই চলবে, আর সংস্কার একদিনে পাল্টানো যায় না। পরিবর্তন হয়তো হবে, কিন্তু আমরা যতো তাড়াতাড়ি চেয়েছিলাম ততো তাড়াতাড়ি নয়। কার কখন হবে সেটা আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই প্রত্যাশা নিয়ে অন্যের ভালো করার চেষ্টা করলে আমাদের হয়তো কষ্টই বেশি পেতে হবে। কর্মবাদের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে, অন্যের ভালো করার চেষ্টা করতে হবে কিন্তু প্রথমেই ভেবে নিতে হবে কোনো প্রত্যাশা করবো না। এতে মনে হতাশা বা রাগ আসবে না।
প্রারব্ধ কর্ম মানে সঞ্চিত কর্মের যে অংশ ফল দিতে আরম্ভ করে দিয়েছে। এখন, প্রারব্ধ কর্মের ফললাভের উপযোগী হয়ে আমাদের এই জন্মের দেহ, মন, পরিবেশ, পরিস্থিতি, সুবিধা-অসুবিধা এসব গঠিত বলে, প্রারব্ধ কর্মের জোর খুব বেশি। যেমন চাকা তৈরিই হয়েছে গড়ানোর জন্য। চাকার গঠন গড়ানোর জন্যেই সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত। সামান্য একটু ধাক্কা লাগলেই গড়িয়ে যাবে। সেই চাকাকে যদি এক জায়গায় স্থির রাখতে হয়, তাহলে যত্ন নিয়ে খেয়াল করে রাখতে হয়, কখন গড়িয়ে যায়। প্রারব্ধ কর্মের গতি আমাদের জীবনে দেহ-মনে এই চাকার গতির মতো সাবলীল। কোনো চেষ্টা ছাড়াই ঘটে যাবে। সেই গতি আটকাতে বা পাল্টাতে গেলেই বরং বিশেষ চেষ্টার প্রয়োজন, যত্নের প্রয়োজন। স্থূল প্রচেষ্টা দ্বারা একে পাল্টানো যাবে না। এ শুধু কথার ব্যাপার নয়, অভিজ্ঞতার বিষয়। আধ্যাত্মিক মহাপুরুষেরা বলেন, ঘটনা হিসেবে প্রারব্ধ কর্মের ফল আসবেই। তবে উচ্চমানের জীবনযাপনের দ্বারা সেই ঘটনার তীব্রতা কমানো সম্ভব। সাধারণতঃ, আমরা যাকে নৈতিক বা ধার্মিক জীবনচারণ বলি, যাকে অনেকেই না বুঝে বা ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে রাখে, তার উপযোগিতাই হচ্ছে এই প্রারব্ধ কর্মের দুর্ভোগের প্রকোপ কম করা। এইরূপ জীবনচারণে কতো সূক্ষ্ম কার্য-কারণ সম্পর্কের বোধ আছে, তা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারলে দেখা যাবে তা সর্বাধুনিক বিজ্ঞানের থেকেও গভীরতায় অনেক এগিয়ে। ‘শ্রীশ্রীমায়ের কথা’ (পৃঃ ১২৩) তে দেখি সারদা দেবীর স্পষ্ট আশ্বাস– "একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, "মা, ভগবানের নাম করলেও কি প্রারব্ধ ক্ষয় হয় না?" মা বলিলেন, "প্রারব্ধের ভোগ ভুগতেই হয়। তবে ভগবানের নাম করলে এই হয়--যেমন একজনের পা কেটে যাবার কথা ছিল, সেখানে একটা কাঁটা ফুটে ভোগ হ'ল।"
এটা ভালো করে বোঝার। সব চিন্তাই কর্ম – কিন্তু সব চিন্তাই ক্রিয়মান কর্ম নয়। আমাদের মনে, আগের বিভিন্ন জন্মের সংস্কার থাকার জন্য, অবচেতন মন থেকে বিভিন্ন রকমের চিন্তা/বাসনা (thought/desire) ওঠে – তার কিছু ভালো, কিছু খারাপ, কিছু আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ। এই চিন্তাগুলো যে উঠছে, অর্থাৎ এই চিন্তাগুলোর অভিজ্ঞতা যে হচ্ছে, এটা প্রারব্ধ কর্মজনিত অভিজ্ঞতা। ভালো চিন্তাও প্রারব্ধ, খারাপ চিন্তাও প্রারব্ধ। এখন যখনই কোনো চিন্তা উঠছে, আমি নিজের ইচ্ছাকে (will) সেই চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করতেও পারি, নাও করতে পারি। যখন আমি চিন্তার বিষয়বস্তুর সঙ্গে নিজের ইচ্ছাকে যুক্ত করে ফেলছি, তখনই সেটা সঙ্কল্প-তে (intention) পরিণত হল। আর যখনই সঙ্কল্প হল, তখনই সেটা ক্রিয়মান কর্ম হয়ে গেল। চিন্তাটা প্রারব্ধ কর্ম, কিন্তু ঐ চিন্তায় ঐচ্ছিক সম্মতিটা ক্রিয়মান কর্ম। হয়তো একটা খারাপ চিন্তা উঠল আপনিই; আমি বুঝতে পারলাম চিন্তাটা সুবিধের নয়, পাত্তা দিলাম না অর্থাৎ ইচ্ছা যুক্ত করলাম না, অন্যদিকে মন দিলাম; এতে কিছুক্ষণ পরেই চিন্তাটা চলে যাবে এমনিতেই। এতে খারাপ চিন্তা উঠলেও আমার খারাপ কর্ম হবে না। কিন্তু যদি ইচ্ছা যুক্ত করে দিই অর্থাৎ যদি ইচ্ছা করে চিন্তাটাকে ধরে রাখি, তাহলে সেটা খারাপ সঙ্কল্প হয়ে খারাপ ক্রিয়মান কর্ম হয়ে গেল, যেটা খারাপ সংস্কার তৈরী করবে। সেই সঙ্কল্প যতো দৃঢ় হবে ক্রিয়মান কর্মের তীব্রতা ততো বেশি হবে। এই সঙ্কল্পই, আগের এক প্রশ্নে যাকে বলা হয়েছে উদ্দেশ্য, কর্মের মাপকাঠি। আমি যদি সুসঙ্কল্প করে অর্থাৎ সদুদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করি, তাতে যদি অসফলও হই, আমার ভালো সংস্কারই উৎপন্ন হবে।
কর্মবাদের বক্তব্য, যৌক্তিকতা ও প্রসার ভালোভাবে বোঝার পর, দৈনন্দিন জীবনে একে প্রয়োগ করার জন্য আমরা সহজে মনে রাখার মতো কিছু সূত্র তৈরী করে নিতে পারি, ও তা করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, এখন হয়তো ভরাপেটে শান্ত মনে ঘরে বসে পড়ছি, তাই কর্মবাদের বোধটা একরকম স্পষ্ট বোধ হচ্ছে। কিন্তু কালকেই যখন রাস্তায় বা কাজে কোনো কারণে মন চঞ্চল হয়ে পড়বে বা শরীর ক্লান্ত থাকবে, তখন আর এখনকার বোধটা থাকবে না। কিন্তু আমার মন শান্ত নয় বলে আশেপাশের জগৎ-জীবন তো অপেক্ষা করে থাকবে না। আমাকে হয়তো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বা কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতার মোকাবিলা হতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি কি বসে থাকব যে কখন মন শান্ত হবে, তখন তা করব? সে সুযোগ থাকলে অবশ্য তাই করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যখন যখন সেই সুযোগ থাকবে না, সেসব সময়ের কথা ভেবে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে জীবনে মেনে চলার মতো কিছু নির্দেশিকা আমরা নিজেরাই তৈরী করে নিতে পারি। তা না করলে কি হবে? মন যখন চঞ্চল হবে, বোধের গভীরতা যখন তাৎক্ষণিক ভাবে ঢাকা পড়বে, তখন মন নিজের মতো করে একটা যুক্তি খাঁড়া করে নিয়ে আমাদের দিয়ে ভুল ব্যবহার করাবে, যার জন্য মন শান্ত হলেই আমাদের আফশোষ হবে। কটা লোক আর রোজ রোজ নিত্যনতুন ভুল করে? জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, আমার একই ভুল বার বার করি। শান্ত মনে যেটাকে খারাপ বলে বোধ আছে, অশান্ত মনে সেটাই করে বসি। বৌদ্ধিক বোধের অভাব নয়, প্রয়োগের জন্য চেষ্টার অভাব, যার কারণ হৃদয়ে উচ্চ আদর্শের জন্য ব্যাকুলতার অভাব। আমাদের বৌদ্ধিক বোধ আর হার্দিক বোধে অনেক তফাৎ। কিন্তু আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে কর্মবাদকে প্রয়োগ করে কিছু ব্যবহারিক সূত্র হিসাবে যদি মনে রাখা যায়, তাহলে সময়ে মনকে জোর করে বলা চলে – তুমি এখন বোঝো না বোঝো, এটাই মেনে চলতে হবে। নিজের মনকে নিজেই মেনে চলাতে হবে। সূত্র যে যার নিজের মতন করে নেবে। কিন্তু শান্ত মনের বোধে একবার সূত্র ঠিক করে নেবার পর আর সেটাকে চট করে পাল্টানো চলবে না, কমপক্ষে বেশ কিছু সময়। ভবিষ্যতে ইতিবাচক পরিবর্তনের দরকার হলে শান্ত মনের বোধেই সেই পরিবর্তন করতে হবে, চঞ্চল মনে কখনই নয়। কী ভাবে কর্মবাদকে সূত্র হিসেবে মনে রাখা যেতে পারে, তার কয়েকটা উদাহরণ হল-
সূত্র ১ – নিজের কোনো মন্দ অভিজ্ঞতার জন্য মনে মনে কাউকে দায়ী করবো না। ব্যাখ্যা: কর্মবাদ বলছে, আমার বর্তমান মন্দ অভিজ্ঞতা আমারই অতীতে কৃত মন্দ কর্মের ফল। সে অভিজ্ঞতা বাইরে কোন ব্যক্তি বা বস্তু বা ঘটনার মাধ্যমে আসছে সেটা বড়ো ব্যাপার নয়; বড়ো ব্যাপার হল সেটা আমার প্রাপ্য ছিল। প্রাপ্য না হলে সেটা আমার কাছে আসতই না। বাড়িতে কোন পোস্টম্যান যদি চিঠি নিয়ে আসে, আর সেই চিঠিতে যদি কোন প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ থাকে, আমরা কি পোস্টম্যানকে ধরে মারধোর করি? সে তো শুধু খবরটা নিয়ে এসছে, যেটা আমাদের প্রাপ্যই ছিল। সে না নিয়ে এলে, আর একজন পোস্টম্যান নিয়ে আসত, কি আছে? সেরকমই, বাইরে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার মন্দ অভিজ্ঞতা হলেও, ঐ অভিজ্ঞতা আমার নিজের কর্মের কারণে আমার প্রাপ্য ছিল বলেই এসছে। যা আমার প্রাপ্য তা একভাবে না এলেও আর একভাবে আসবে। তাই আমার মন্দ অভিজ্ঞতা হলে বাইরে লোকলজ্জ্বার খাতিরে তাৎক্ষণিক যাই প্রতিক্রিয়া করে ফেলি না কেন, মনে মনে শেষমেষ কখনই অন্যকে দায়ী করব না।
সূত্র ২ – মন্দ অভিজ্ঞতায় ধৈর্য হারিয়ে অনৈতিক প্রতিক্রিয়া করবো না। ব্যাখ্যা: কর্মের শেষ অভিজ্ঞতায়। অতীতে কৃত মন্দ কর্ম বর্তমানে মন্দ অভিজ্ঞতা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দিয়েই তার শেষ। সেই মন্দ সংস্কার আর থাকল না। কিন্তু মন্দ অভিজ্ঞতায় ধৈর্য হারিয়ে আমরা অনেক সময় অনৈতিক প্রতিক্রিয়া করে বসি, আর মনে মনে হয়তো ভাবি এত দুঃখের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ওটুকু অনৈতিক কার্য সমর্থনযোগ্য। কিন্তু তা তো নয়। কর্মবাদ অনুযায়ী, বর্তমান অভিজ্ঞতার সংযোগ অতীতের কর্মের সাথে, বর্তমানের প্রতিক্রিয়ার সাথে নয়। প্রারব্ধ কর্ম দ্বারা বর্তমান অভিজ্ঞতা নির্দিষ্ট, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতায় কি প্রতিক্রিয়া করব তা নির্দিষ্ট নয়। অঙ্কের ভাষায়, অতীত মন্দ কর্ম ‘-’ আর বর্তমান মন্দ অভিজ্ঞতা ‘+’ মিলেমিশে কাটাকটি হয়ে গেল। কিন্তু বর্তমান মন্দ প্রতিক্রিয়া আবার নতুন একটা মন্দ কর্ম, যেটা বর্তমান মন্দ অভিজ্ঞতার সাথে মিশে কাটবে না। সেই নতুন কর্মের ফল আবার ভবিয্যতে আসবে মন্দ অভিজ্ঞতা আসবে। অতএব, মন্দ অভিজ্ঞতায় অনৈতিক প্রতিক্রিয়া না করতে পারলেই আমাদের লাভ হবে। এখানেই ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করতে হবে।
সূত্র ৩ – ভালো সময় চলাকালীনও ভালো কাজ বন্ধ রাখব না। ব্যাখ্যা: ভালো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অতীতের ভালো কর্মও কিন্তু শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই ভালো সময় চললেও, নিশ্চেষ্টভাবে না থেকে ভালো কাজ বা অভ্যাস কমবেশী চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। জীবনে খারাপ সময় এলে তো অনেকেরই ভালো অভ্যাসের দিকে মন যায়, সেটা প্রকৃত হার্দিক বোধের পরিচায়ক নয়। কিন্তু ভালো সময় চলাকালীনও যে ভালো অভ্যাস ছাড়ে না, তার হার্দিক বোধ অবশ্যই হয়েছে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা ভাগ্য, অদৃষ্ট, কপাল, নিয়তি, বিধি, দৈব – এই শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। এগুলোর সাথে কর্মবাদের সম্পর্ক কোথায়? সম্পর্ক নির্ভর করছে এই শব্দগুলো কে কোন বোধ থেকে ব্যবহার করছে তার ওপর। দুটো লোক কথায় একই শব্দ ব্যবহার করলেও, তারা একই মনোভাব থেকে নাও করতে পারে। অতএব এই প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের নিজেকে করা উচিৎ। ভাগ্য বলতে আমি নিজে কি বুঝছি? যদি ভাগ্য বলতে আমি এমন কিছু বুঝি, যাতে আমার বর্তমানে কোনো হাত নেই, অতীতেও কোনোভাবে হাত ছিলনা এবং ভবিষ্যতেও কোনোভাবে হাত থাকবেনা, তাহলে সেটা কর্মবাদ নয়। কিন্তু ভাগ্য বলতে যদি আমি বুঝি এমন কিছু যার ওপর আমার অতীতে কোনো সময়ে নিয়ন্ত্রণ ছিল, কিন্তু বর্তমানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা সীমিত নিয়ন্ত্রণ আছে, তাহলে সেটা কর্মবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ সেক্ষেত্রে প্রারব্ধ কর্মকেই আমরা একরকম ভাগ্য বলছি। আর প্রারব্ধ কর্মের জন্য আমিই দায়ী, অন্য কেউ বা অন্য কিছু নয়, কাজেই সেই ভাগ্যের জন্যেও আমিই দায়ী। ভাগ্য না বলে বিধি, নিয়তি, অদৃষ্ট ইত্যাদি যাই বলি না কেন, বুঝতে হবে আমি শুরুতে কাকে দায়ী করছি। আমি যদি শুরুতে আমাকে দায়ী করি, তাহলে সেটা কর্মবাদ। যদি শুরুতে অন্য কিছুকে দায়ী করি, সেটা কর্মবাদ নয়। আমি একটা খারাপ কাজ করলাম, কিন্তু পরদিনই মনে হল ভুল করেছি আর করব না। সত্যিই হয়তো পরদিন সুযোগ পেলেও আমি সেই কাজ করব না। কিন্তু তা বলে পূর্বে কৃত খারাপ কাজের ফল নষ্ট হবে না, কারণ যে মুহুর্তে কাজটা করেছিলাম সেই মুহুর্তে আমার সংকল্প খারাপ ছিল, আর সংকল্পই কর্মের মাপকাঠি। কাজেই সেই ফল আসবেই। যখন আসবে তখন সেই ফলকে যদি আমি ভাগ্য বলি, বলতেই পারি, কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই ভাগ্য আমারই তৈরী। এক সময়ে সেই ভাগ্য সৃষ্টি করা বা না-করা আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু এখন তা সৃষ্ট, তাকে অস্বীকার করা যাবে না। তবে এখানে কিন্তু বলা হচ্ছে না যে প্রভাবিত করা যাবে না, বলা হচ্ছে অস্বীকার করা যাবে না, অর্থাৎ আমি সেটা বিশ্বাস না করলেও বা ভুলে গেলেও সেই কর্মফলজনিত খারাপ অভিজ্ঞতা আমার হবেই কোনো না কোনো সময়ে। কিন্তু অস্বীকার না করে যদি উপযুক্ত উচ্চমানের কর্ম ও জীবনযাপন করি, তবে সেই ভালো কর্মের শক্তিতে ঐ খারাপ কর্মজাত অভিজ্ঞতাকে প্রশমিত করা সম্ভব। কর্মবাদ অনুসারে, এইভাবেই আমাদের ভবিষ্যৎ ভাগ্যও আমরা বর্তমানে গড়ছি। আসলে এটা মেনে নিতে অসুবিধা হয়, কারণ পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি আমাদের এখন নেই। কিন্তু স্মৃতি নেই বলে পূর্বজন্মের অস্তিত্বও নেই, এটা যুক্তিসঙ্গত হলো না। এই জন্মেই একেবারে বাচ্চা বয়সের কথা আমাদের স্মৃতিতে নেই। আমরা কি একইভাবে সন্দেহ করি যে আমি ছিলাম না সেই সময়ে? যদি বলি অন্যদের কথা থেকে জানতে পারি আমি ছিলাম, তাহলে বলতে হয় যে মুহুর্তে অন্য কেউ ছিল না আমার পাশে, সেই মুহুর্তে আমার অস্তিত্ব ছিল না। উল্লেখযোগ্য যে ‘অদৃষ্ট’ শব্দটা এসছে মীমাংসা দর্শনের একটা মতবাদ থেকে। সেই মতবাদের পটভূমি ছিল কীভাবে যাগযজ্ঞাদি কর্মের মাধ্যমে স্বর্গলাভ হয়। কেউ যজ্ঞ করল আজকে, কিন্তু তাঁর স্বর্গলাভ হবে মৃত্যুর পর, তাহলে এই যজ্ঞরূপ কর্মের সঙ্গে স্বর্গলাভরূপ ফলের যোগসূত্রটা কি — এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মীমাংসকরা ‘অপূর্ব’ বা ‘অদৃষ্ট’ বা ‘অতিশয়’ বলে একটা শক্তির কথা বলেন যেটা কর্ম থেকে উৎপন্ন হয়। কর্ম শেষ হয়ে গেলেও সেই শক্তি থেকে যায় সাধারণ দৃষ্টির অলক্ষ্যে; পরে সেই শক্তির দ্বারাই স্বর্গলাভ হয়। এই আলোচনায় আগে যাকে সংস্কার বলা হয়েছে, অদৃষ্ট সেটারই আর এক নাম। দার্শনিক মতবাদ থেকে শব্দটা দৈনন্দিন জীবনে প্রচলিত হয়ে গেছে।
আগে বলা হয়েছে সংকল্পই কর্মের মাপকাঠি। আমার কোনো কাজে কারোর ক্ষতি হয়ে গেলেও আমার সংকল্প যদি ভালো থাকে, তাহলে আমার খারাপ কর্ম হবে না, এটা আগে বলা হয়েছে। তবে এবারে আরো গভীর স্তরে ব্যাপারটা দেখা যাক। কেউ যদি আমাকে বলে – তুমি আগে থাকতে ভালো করে দেখে-বুঝে কাজটা করোনি কেন? তোমার কাজে যে অন্যের ক্ষতি হতে পারে এটা তুমি বুঝতেই পারতে যদি কাজটা করার আগে আরো একটু ভেবে দেখতে – এর উত্তর আমি কি দেব? আমি একটা সুসংকল্প থেকেই কাজটা করেছি সন্দেহ নেই, কিন্তু কাজটা করার আগে হয়তো তাড়াহুড়ো করেছি বলে ভালো করে ভেবে দেখি নি সত্যিই। সেই হঠকারিতার জন্যে আমার কাজে কিভাবে অন্যের খারাপ হতে পারে সে বিষয়ে সেভাবে বিবেচনা করিনি, কিন্তু করতেই পারতাম। সেটা না করার জন্যেই তাহলে অন্যের খারাপ হয়েছে, এরকম বলাই যায়। আর সেক্ষেত্রে তাহলে সেই অবিবেচনাররূপ সংকল্পের জন্য আমার খারাপ কর্ম হবে। এ এক গভীর ব্যাপার। এর জন্যেই গীতায় বলা হয়েছে – "গহনা কর্মনা গতিঃ।" (গীতা ৪.১৭)
কর্মের গতি গহিন। একটা কাজ অনেক রকম সংকল্প থেকেই করা যায়। এক সুসংকল্প থেকে করলে হয়ত অন্য সুসংকল্পকে অবহেলা করা হয়। তাহলে কি করব? বাস্তবে আমরা যদি একটা কাজ করার আগে সমস্তরকম দিক ভেবে কাজ করতে চাই, তাহলে সারা জীবনেও হয়তো কাজটা করা হবে না, কারণ অসংখ্য দৃষ্টিভঙ্গী সম্ভব। আর এভাবে কিছু সময় ভাবলে লোকে পাগল হয়ে যাবে। আমি জানি যে আমি চেয়ারে বসলেই অসংখ্য জীবাণু মারা যাবে। তাহলে বসি কি করে? সেভাবে কোনো কিছুই বা করি কি করে? এই স্তর থেকে দেখলে বোঝা যাবে, কোনো কর্মই পুরোপুরি ভালো বা পুরোপুরি মন্দ হতে পারে না, সমস্ত কর্মই ভালো-মন্দ মিশ্রিত। কিন্তু মিশ্রিত হলেও ভালোর প্রাধান্য বা মন্দের প্রাধান্য অনুযায়ী কর্মের উচ্চতা নির্ধারিত হতে পারে। কোনটা উচ্চতর কর্ম বুঝব কি করে? উত্তর হচ্ছে, যেটা উচ্চতর সংকল্প থেকে এসছে। কর্মের উচ্চতার পরিমাপক সংকল্প। আর কোনটা উচ্চতর সংকল্প কি করে বুঝব? অর্থাৎ সংকল্পের উচ্চতার পরিমাপক কি? – পরিমাপক হচ্ছে সার্বজনীনত্ব। যে সংকল্প যতো সার্বজনীন বা সার্বভৌমিক বা বৃহত্তর (universal), তা ততো উচ্চ। যে সংকল্প যতো ব্যক্তিগত বা সীমিত বা ক্ষুদ্র, তা ততো নিম্ন। এবারে বোঝা যাবে, নিঃস্বার্থতা বা স্বার্থশূন্যতার এতো গুরুত্ব কেন ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক জগতে। যার সংকল্প যতো নিঃস্বার্থ, তার সংকল্প ততো উচ্চ ও সেই সংকল্পপ্রসূত কর্মও ততো উচ্চ। নিঃস্বার্থ মানে, সে শুধুই নিজের কথা ভাবছে না, নিজের বাইরে কিংবা নিজের বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের গণ্ডীর বাইরেও অন্য কারুর বা অন্য অনেকের কথা ভাবছে। বাইরে কে কি করছে, সেটা থেকে তার সংকল্পের উচ্চতা বোঝা মুশকিল। অনেকদিন ধরে দেখলে বোঝা যেতে পারে, কিন্তু চট করে বোঝা খুব কঠিন। তবে কিছু সাধারণ বোধ আছে। একেবারে নিঃস্বার্থ মুখে বললেই হওয়া যায় না; শুনতে ভালো লাগে কিন্তু ভিতরে সেই ভাব ঠিক আসে না। আমাদের শাস্ত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে – ‘চিত্তশুদ্ধি’। মনের শুদ্ধতা। মন শুদ্ধ না হলে প্রকৃত নিঃস্বার্থ ভাব আসতেই পারে না। আর মনকে শুদ্ধ করার জন্যই সমস্ত নৈতিক আচার আচরণ – যেমন সত্য কথা বলা, কাউকে আঘাত না করা, শরীর ও মনের সংযম ইত্যাদি। আর নৈতিকতা মেনে চলা সহজ হয় যদি তার সাথে শুধু বুদ্ধির নয়, হৃদয়েরও যোগ থাকে। আর হৃদয়ের যোগ সবচেয়ে অধিক হয় যদি ঈশ্বর বা ভগবানের জন্য তা করা হয়। যার ঈশ্বরে বিশ্বাস বা ভালোবাসা আছে তার পক্ষে নৈতিকতা মেনে চলা অনেকটা সহজ হয়; যার তা নেই, তাকে বেশী বেগ পেতে হয়। অপরদিকে, যে অনৈতিক, তার পক্ষে প্রকৃত নিঃস্বার্থতা অনেক দূরের জিনিস, কারণ তার সংকল্প কখনই খুব সার্বভৌমিক বা সার্বজনীন হতে পারে না। এমনকি, কোনো বিশেষ রূপে ঈশ্বর-বিশ্বাস ছাড়াও নিঃস্বার্থ ভাব কষ্টকর হলেও আসতে পারে, কিন্তু যথেষ্ট নৈতিক জীবনযাপন ছাড়া নিঃস্বার্থ ভাব অসম্ভব। সেজন্যই নৈতিকতা আধ্যাত্মিক জীবনের ভিত্তিভূমি। যার জীবন আধ্যাত্মিকতায় যতো উন্নত, তার সংকল্প ততো বৃহত্তর, কাজেই তার কর্মও ততো উচ্চতর।
এখনও পর্যন্ত আমরা ভালো বা খারাপ চিন্তায় ঐচ্ছিক সম্মতি, অর্থাৎ সংকল্প-কেই কর্ম বলে এসেছি। তবে কর্মের প্রকৃত ধারণা আরোও গভীর, যেটা এবারে দেখব। সাধারণতঃ, জীবনের ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতার কথা যখন ভাবা হয়, তখন সেই সমস্ত কর্মের ও সংস্কারের কথাই ভাবা হয় যেগুলো এমন কোনো চিন্তায় ঐচ্ছিক সম্মতি থেকে এসছে, যে চিন্তার ভালোত্ব বা মন্দত্ব সম্বন্ধে আমাদের একটা বোধ আছে। তার কারণ, সেই সমস্ত সংস্কারই ভবিষ্যতে ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতা দেবে। তবে কর্মের বৃহত্তম ধারণা হলো এই যে – দেহ ও মনের সমস্ত রকম গতিই কর্ম – তা ভালো-মন্দ বোধযুক্ত সচেতন গতিই হক, ভালো-মন্দ বোধহীন সচেতন গতিই হক, কিংবা অনৈচ্ছিক বা অচেতন গতিই হক। এই সমস্ত রকম গতিই সংস্কার বা অনুরণন বা ছাপ ফেলে। তবে এদের মধ্যে শক্তির মাত্রার তারতম্য আছে। ভালো-মন্দ বোধযুক্ত সচেতন গতি থেকে যে সংস্কার, তা এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, এবং এই সংস্কারই ভবিষ্যতে সুস্পষ্ট ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়; সেইজন্যই কর্মবাদের প্রাথমিক আলোচনায় এই ধরণের কর্মের কথাই বলা হয়। অন্যদিকে, ভালো-মন্দ বোধহীন সচেতন গতি এবং অনৈচ্ছিক বা অচেতন গতি থেকে যেসমস্ত সংস্কার উৎপন্ন হয়, তাদের শক্তি অপেক্ষাকৃত কম। তাই তারা সেভাবে বিশেষ ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় না। কিন্তু বিশেষ ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতার জন্ম দিক বা না দিক, সমস্ত রকমের সংস্কারই একত্রে আমাদের দেহ ও মনের প্রকৃতি নির্ধারণ করে।
জীবনের সব অভিজ্ঞতাকেই কি আমরা ভালো বা মন্দ বলি? একটা লোক আমার সামনে দিয়ে গেল, আমি দেখলাম। এই দেখাটাকে কেউ সাধারণতঃ ভালো বা মন্দ বলবে না, এটা নিরপেক্ষ অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাও কর্ম, কারণ মনের একপ্রকার গতি (cognition), এবং সেই গতি ছাপ বা সংস্কারও তৈরী করবে, কিন্তু সেই সংস্কার ভবিষ্যতে ভালো বা মন্দ বলা যায় এরকম অভিজ্ঞতা উৎপন্ন করবে না। দেহ ও মনের কতো প্রকার গতিই হতে পারে। সে সবই বৃহত্তর দৃষ্টিতে কর্ম। যে কোনো রকম ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ বা মানসিক প্রত্যক্ষ, দৈহিক বা মানসিক প্রচেষ্টা, চিন্তা, আবেগ-অনুভূতি – সবই কর্ম। মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ইত্যাদি এগুলোকে কি আমরা ইচ্ছা করে চেষ্টা করে চালাচ্ছি? না। এগুলো অনৈচ্ছিক ভাবেই চলছে। কিন্তু কর্মের বৃহত্তম বোধে এগুলোও কর্ম, অর্থাৎ অনৈচ্ছিক কর্ম, কারণ সংস্কার বা অনুরণন তৈরী করবে। চেয়ারে বসে আছি, এটা ভালো-মন্দ বোধহীন ঐচ্ছিক কর্ম। রাস্তায় হাঁটছি, কর্ম। মনে মনে একটা গাছ চিন্তা করলাম, কর্ম। কথা বলছি, গান শুনছি, হাসছি, কাঁদছি, চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি, স্বপ্ন দেখছি সবই কর্ম। এমনকি স্বপ্নহীন গভীর ঘুমও কর্ম। এই সমস্তই সংস্কার বা ছাপ ফেলে। এই হচ্ছে কর্মের ও সংস্কারের বৃহত্তম ধারণা। এ বিষয়ে নীচে আরো আলোচনা হবে।
কর্মের বৃহত্তম ধারণার পরিপ্রেক্ষিত থেকে স্মৃতি কি তা বোঝা যাবে। রোজকার ভাষায় আমরা যাকে স্মৃতি বলি, তা আমাদের এখনো পর্যন্ত সমস্ত রকম কর্মজাত সংস্কার বা অনুরণন-সমুদ্রের এক অতি সামান্য অংশ বই আর কিছু নয়। যেটুকু অংশ সম্বন্ধে আমরা বর্তমানে সচেতন, তাকেই স্মৃতি বলি। কালকে রাত্রে কি খেয়েছি সেটা মনে করার চেষ্টা করলাম; করতেই মনে এল কি খেয়েছি। এই যে মনে করতে পারলাম, এটা অভিজ্ঞতার অনুরণন রূপে সংস্কার ছাড়া সম্ভব নয়। যে কোনো অতীত অভিজ্ঞতারই সূক্ষ্ম স্পন্দন এইভাবে আমাদের ভেতরে রয়েছে। সেই স্পন্দনকে যথেষ্ট একাগ্রতা শক্তি দিয়ে বিবর্ধিত করতে পারলেই তা স্মৃতি হিসাবে ভেসে উঠবে। যে গতি যতো বেশি বার হয়েছে, তার সংস্কারগুলো একসাথে মিশে ততো বেশি জোরালো হয়ে ওঠে, তাই তার স্মৃতিতে আসার প্রবণতা ততো বেশি থাকে।
পুনর্জন্মের প্রসঙ্গে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। আমরা আগে যদি জন্মেই থাকি তো সেইসব জন্মের কথা মনে নেই কেন? প্রথমেই বলা যাক, এরকম অনেক ঘটনাই দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে যেখানে কেউ কেউ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো অল্প বয়সের ছেলে বা মেয়ে, বিক্ষিপ্তভাবে আগের জন্মের কথা মনে করতে পেরেছে। সাধারণতঃ বয়স বাড়লে এই ধরণের স্মৃতি চলে যায় দেখা গেছে। বর্তমান সময়ে কানাডীয়-মার্কিন মনোবিজ্ঞানি ইয়ান স্টিভেনসন এবিষয়ে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে বইপত্র লিখেছেন। প্রথমেই বোঝা দরকার, আমাদের মনের খুব সামান্য অংশ সম্বন্ধেই আমরা এক সময়ে সচেতন। দশদিন আগে এই সময়ে কি চিন্তা করেছিলাম, সেটা কি আমার মনে আছে? কালকে যতজন লোককে রাস্তায় দেখেছি, তাদের সবার মুখ কি আমার মনে আছে? চেষ্টা করলেও কি সব মনে করতে পারব এখন? ছোটোবেলা থেকে কতো দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, কতো চিন্তা, কতো কল্পনা আমরা করেছি। কতো জিনিস এসছে গেছে। তার কতটুকুই এই মুহুর্তে আমরা মনে করতে পারছি? মাঝে মাঝে পুরোনো জিনিস মনে পড়ে, মনে হয় কতোদিন পর চিন্তাটা আবার এল, কিন্তু আবার সেটা চলে যায়, হয়তো আবার কয়েক বছর পর আসবে। কিন্তু যখন সেটা চলে যায়, সেটা কোথায় যায়? সেটা আমাদের সূক্ষ্ম শরীরেই থাকে, শুধু সচেতন মনের সীমার নীচে চলে যায়। মনের এই যে অংশ সম্বন্ধে আমরা সচেতন নয়, তাকে অবচেতন মন বা অচেতন মন বলা হয়। যোগীরা বলেন, মনের অতি, অতি সামান্য অংশ সম্বন্ধেই সাধারণ মানুষ এককালে সচেতন। বর্তমান জন্মেরই সমস্ত অভিজ্ঞতার খুব সামান্য অংশ আমাদের সচেতন মনে এই মুহুর্তে আছে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, পূর্বের অন্যান্য জন্মের সংস্কার অবচেতন মনে থাকলেও তাকে সচেতন মনে আনা কতোটা কষ্টকর।
এবার আরো একটু খুঁটিয়ে বোঝা যাক। আধুনিক বিজ্ঞান বুঝেছে যে আমাদের যে কোনো অভিজ্ঞতাই আমাদের মস্তিষ্কে তদনুরূপ একটা দাগ কেটে যায়, অর্থাৎ সমস্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মস্তিষ্ক একটু করে পরিবর্তিত হয়। একে বলে নিউরোপ্লাস্টিসিটি (neuroplasticity)। তবে আগেও যেমন বলা হয়েছে, যেটা বিজ্ঞান এখনো সাধারণভাবে বুঝতে পারে নি, সেটা হলো যে কোনো অভিজ্ঞতা শুধু মস্তিষ্কে দাগ কেটেই বিলীন হয়ে যায় না, তারপর সেটা সূক্ষ্ম স্পন্দন হিসাবে অবচেতন মনে অবস্থান করে, যাকে সংস্কার বলা হয়। আমরা এই জন্মে যতদিন বেঁচে আছি, আমাদের মস্তিষ্ক সক্রিয় আছে। তাই এই জন্মে ঘটেছে এরকম অভিজ্ঞতার সংস্কার, স্মৃতি হিসাবে ভেসে ওঠার জন্য মস্তিষ্কের থেকে সহায়তা পায়, কারণ মস্তিষ্কেও সেই অভিজ্ঞতার একটা ছাপ রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মস্তিষ্ক ও তার ছাপ স্থূল শরীরের অংশ, আর মন ও সংস্কার সূক্ষ্ম শরীরের অংশ। তাই এক জন্মের শেষে যখন দেহের মৃত্যু হয়, মস্তিষ্ক তার সমস্ত ছাপসহ ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু সমস্ত সংস্কার সমেত সূক্ষ্ম শরীর বর্তমান থাকে। সেই সূক্ষ্ম শরীর প্রারব্ধ কর্মানুসারে অন্য এক স্থূল দেহের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়, যাকে পুনর্জন্ম বলা হয়। কিন্তু সেই নতুন স্থূল দেহের মস্তিষ্কে আগের জন্মের অভিজ্ঞতার কোনো ছাপ নেই। সেজন্যই আগের জন্মের সমস্ত সংস্কার নতুন জন্মের সূক্ষ্ম শরীরে বর্তমান থাকলেও মস্তিষ্ক থেকে কোনো সহায়তা পায় না বলে সাধারণতঃ স্মৃতি হয়ে ভেসে ওঠে না।
মনে রাখতে হবে যে কোনো একটি বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার সংস্কার খুবই সূক্ষ্ম অনুরণন, তাই তাকে স্মৃতির অনুরণনে উঠে আসার জন্য যথেষ্ট শক্তি অর্জন করতে হয়। মস্তিষ্কের সহায়তা ছাড়া সেই শক্তি আসতে পারে মনের গভীর একাগ্রতা থেকে। কিন্তু মনের চিন্তা-বাসনাদি বৃত্তি খুব শান্ত না হলে সেই স্তরের একাগ্রতা আসে না; তাই কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সাধারণ মানুষ গত জন্মের অভিজ্ঞতাকে স্মৃতি হিসাবে দেখতে পারে না।
একটা উদাহরণে ব্যাপারটা কিছুটা বোঝা যাবে। ধরা যাক, দিনের বেলা একটা ঘরে সমস্ত দরজা-জানলা ভালো করে বন্ধ করে একদম অন্ধকার করে একটা খুবই কমজোরী সস্তার পুরোনো দিনের প্রোজেক্টর দিয়ে একটা সাদা স্ক্রিনে ছবি দেখানো হচ্ছে। ছবি দেখা যাচ্ছে অন্ধকার বলে। এবারে সব জানলা-দরজা খুলে দেওয়া হল; গোটা ঘর সূর্যের আলোয় ভরে গেলো। এবারে স্ক্রিনে তাকালে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু সাদা স্ক্রিন সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু সেই সময়েও স্ক্রিনে কিন্তু আগের মতোই ছবি পড়ছে। কিন্তু সূর্যের আলোর তুলনায় সে ছবি এতই ম্লান যে, আমাদের চোখে ধরা পড়ছে না। সেরকমই, আমাদের অবচেতন মনে পূর্বের সমস্ত জন্মের অভিজ্ঞতারই ছবি বর্তমান আছে এই মুহুর্তেই। কিন্তু আমাদের বর্তমান জন্মের বিভিন্ন ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতা, সূর্যের আলোর মতই, অবচেতন মনে এত উজ্জ্বল প্রভাব বিস্তার করছে যে আমরা পূর্বজন্মের অভিজ্ঞতার স্মৃতি ধরতে পারছি না। দরজা-জানলা বন্ধ করার মতোই যদি সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অভিজ্ঞতা লাভ বন্ধ করে অবচেতন মনে যথেষ্ট একাগ্রতায় দৃষ্টিপাত করা যায়, তাহলে পূর্বের সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা স্মৃতির আকারে ভেসে উঠতে পারে।
আগের বিভিন্ন জন্মের অভিজ্ঞতার দেশ-কাল-বস্তু সম্বদ্ধ বিশেষ স্মৃতি আমাদের এখন না থাকলেও, সমস্ত সংস্কারের যে সংহত সার্বিক প্রভাব, সেই প্রভাবই প্রারব্ধ কর্মরূপে আমাদের বর্তমান জন্মের দৈহিক ও মানসিক ধর্ম, প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্য রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। এই সমস্ত প্রবণতার সংযোগকেই আমরা চরিত্র বলে থাকি। আমাদের বর্তমান চরিত্র আমাদের সমস্ত অতীত সংস্কারের সংহত প্রভাব। সমস্ত সংস্কার একটা একটা করে মনে করতে পারি বা না পারি, সমস্ত সংস্কারের যে শক্তি, সেই সমস্ত শক্তি একত্র হয়ে আমাদের বর্তমান চরিত্রের শক্তি হিসাবে বর্তমান। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন প্রবণতাই তাদের বিভিন্ন অতীত জন্মের পরিচায়ক। অনেক সময় দেখা যায়, একই পরিবারে ও পরিবেশে দুজন বড়ো হল – দুজন দুরকম হল। এমনকি সম্পূর্ণ যমজ ভাই বা বোন (identical twin), দুজনের দুরকম মানসিকতা। কারুর ছোটোবেলা থেকেই কোনো বিষয়ে অভাবনীয় প্রতিভা। কারোর অল্প বয়স থেকেই ভীষণ মনের জোর। এগুলো কি করে হয়? বর্তমানে বিজ্ঞানের জিন ও বংশগতি তত্ত্ব (heredity and genetics) এবিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করে চলেছে। গত কয়েক দশকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনেক সূক্ষ্ম স্তরে প্রবেশ করেছে; কিন্তু সেই সূক্ষ্ম স্তরও স্থূল শরীরেরই অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম স্তর; আমরা যে সূক্ষ্ম শরীরের কথা বলেছি ওপরে, তা এখনও নয়।
ভালো বা মন্দ প্রারব্ধ কর্ম ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতা হিসাবে ফল দেবে। কিন্তু এবারে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে আমরা জীবনে যত বিশেষ দুঃখ-কষ্ট পাই, তার পুরোটাই কি প্রারব্ধ কর্মের জন্য? উত্তর হচ্ছে না। এটা খুব ভালো করে বোঝার। ধরা যাক প্রারব্ধ কর্মের জন্য আমার জীবনে একটা খারাপ অর্থাৎ প্রতিকূল ঘটনা ঘটল। যেটা চাইনি বা চাইনা, সেরকম কিছু হল। এতে তাৎক্ষণিক একটা ধাক্কা লাগল মনে, একটা বেদনাবোধ হল। কিন্তু সেই তাৎক্ষণিক বেদনাবোধের পরেও আমি বিচলিত হয়ে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ভাবতে লাগলাম – আমার এরকম কেন হল? আমারই কেন হল? আমি কি এমন করেছিলাম? আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল! আর ভালো মানুষ থেকে লাভ নেই! এরকম হলে আমি কি করে কিছু করব? – ইত্যাদি ইত্যাদি কত কি। ভাবি আমাদের বিশেষভাবে প্রতিক্রিয়া যেন করতেই হবে। না করলে যেন যুক্তিযুক্ত হচ্ছে না। এই যে ক্রমাগত ঐ প্রতিকূল অভিজ্ঞতায় মনে মনে প্রতিক্রিয়া করে চলেছি, এতেই আমার দুঃখবোধটা আরো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু এই অতিরিক্ত দুঃখবোধ কিন্তু প্রারব্ধ কর্মের জন্য নয়; এটা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ক্রিয়মান কর্মের জন্য। যেটুকু দুঃখ প্রারব্ধ কর্মের জন্য পাওয়ার কথা, আমরা অনেক সময়ই তার থেকে বেশী পাই, কারণ মনের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা কিছুতেই সহজে মেনে নিতে চাই না (accept) যে আমাদের কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা হতে পারে। তাই প্রাথমিক দুঃখবোধের পরেও সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি, যার থেকে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, ভয় মনে এসে পড়ে, যার ফলে উল্টে হয়তো আরো খারাপ কিছু করে বসি, এবং শেষমেষ যতটা না পাবার, তার চেয়ে অনেক বেশি মানসিক দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করে বসি। অভিজ্ঞ ডাক্তাররা, যারা দীর্ঘকালস্থায়ী রোগে (chronic disease) আক্রান্ত রোগীদের দেখে আসছেন অনেকদিন ধরে, তারা অনেকেই জানেন ও বলেও থাকেন যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঐ ধরণের রোগী যে কষ্ট পায় তার অধিকাংশটাই মানসিক উদ্বেগের কারণে এবং অল্প অংশই প্রকৃত শারীরিক রোগের কারণে। কারণ রোগের প্রকোপ অল্প হলেও, বার বার হবার ফলে রোগী একটু কিছু হলেই আশঙ্কা করতে শুরু করে এই বুঝি হল, এবারে কি হবে ইত্যাদি। ফলে অতিরিক্ত কষ্টভোগ করে। প্রারব্ধ কর্মজনিত অভিজ্ঞতা সহজে পাল্টানো না গেলেও, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভ্যাসের দ্বারা আমরা কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত দুঃখবোধকে কমাতেই পারি। তবে আধ্যাত্মিক জীবনযাপন দ্বারা প্রারব্ধ কর্মের প্রকোপকেও কমানো সম্ভব, যেটা আগে বলা হয়েছে।
আগে বলা হয়েছে, কর্মের বৃহত্তম দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেহ ও মনের যে কোনো প্রকার গতিই কর্ম – তা ঐচ্ছিক গতিই হক বা অনৈচ্ছিক গতিই হক। ঐচ্ছিক গতি আমরা বুঝি। অনৈচ্ছিক গতি কি? যেমন আমাদের শরীরের ভেতরে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ ইত্যাদি সব চলছে, রক্তচলাচল হচ্ছে সারা দেহে, যে খাবার খেয়েছি তা হজম হচ্ছে, সারভাগ সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে, অসার ভাগ বর্জ্যপদার্থ হিসাবে প্রস্তুত হচ্ছে, কোষ-বিভাজন হচ্ছে, চুল নখ বড়ো হচ্ছে – এরকম কতো কি প্রক্রিয়া হয়ে চলেছে সমস্ত সময়। আমরা কি এগুলো ইচ্ছা করে করছি? সাধারণভাবে কোনো লক্ষ্যই নেই আমাদের এগুলোর দিকে, কিন্তু এগুলো হয়ে চলেছে। সত্যি বলতে, এই সমস্ত জিনিস যদি আমাদের ইচ্ছা করে চালাতে হত, তাহলে কয়েক সেকেণ্ডেই আমাদের মৃত্যু হতো, কারণ সব কিছুকে খেয়াল রাখা অসম্ভব হতো। এই সমস্তই হচ্ছে অনৈচ্ছিক দৈহিক কর্ম, এবং অনৈচ্ছিক বলেই আমরা বেঁচে আছি। বিজ্ঞানে যেগুলোকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া (reflex action) বলে সেগুলোও অনৈচ্ছিক। শ্বাস-প্রশ্বাসও অনৈচ্ছিক, তবে এটা এমন একটা প্রক্রিয়া যাকে খেয়াল করে ঐচ্ছিক করা যায়। ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ড বা যকৃতের কাজে আমরা ইচ্ছা করেই সরাসরি কোনো পরিবর্তন সহজে আনতে পারব না। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাস অনৈচ্ছিক ভাবে আপনা-আপনি চললেও, ইচ্ছা করলেই একে আমরা সহজে ঐচ্ছিক ভাবে চালাতে পারি। এরকম আর একটা উদাহরণ হল চোখের পাতা পড়া। পরে আমরা দেখব, এজন্যই মনকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হিসাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণকে ব্যবহার করা হয়, কারণ এই প্রক্রিয়া দেহে ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক গতির মিলনস্হল।
এবার মানসিক অনৈচ্ছিক কর্মের উদাহরণ দেখা যাক। মনে হঠাৎ করে একটা চিন্তা উঠল। ওঠার পর চিন্তাটা ইচ্ছা করে করব, না কি ইচ্ছা করে এড়িয়ে যাব, সেটা ঐচ্ছিক। কিন্তু চিন্তাটা যে উঠল, এটা অনৈচ্ছিক কর্ম। আমি হয়তো কাউকে ভয় করি। সে আমার দিকে তাকাতেই আমার মনে ভয় এল। ইচ্ছা করে যুক্তি দিয়ে ভেবে যে ভয় নিয়ে এলাম তা নয়, দেখামাত্রই ভয় এল। যাকে ভালো লাগে, তাকে দেখতেই মনে আনন্দ এল। এরকম, কিছু জিনিস বা ঘটনা দেখলেই আমাদের মনে তৎক্ষণাৎ কোনো বিশেষ চিন্তা বা আবেগের উৎপত্তি হয়। এগুলি সবই মানসিক অনৈচ্ছিক কর্ম।
আগে দেখেছি, সব কর্ম বিশেষ ভালো বা মন্দ অভিজ্ঞতা উৎপন্ন না করলেও সব কর্মই দেহ ও মনের প্রবণতা নির্ধারণে ভূমিকা নেয়। যে কর্ম যতবার করা হয়, তার সংস্কারগুলো একে অপরের সাথে মিশে তত শক্তিশালী হয়ে পড়ে। সংস্কার যতো শক্তিশালী হয়, ইচ্ছা করলে ততো সহজে কাজটা আমরা করতে পারি। এটাই হচ্ছে কোনো কিছু অভ্যাস করার কারণ। কোনো কিছু শিখতে গেলে আমরা অভ্যাস করতে বলি কেন? অভ্যাস করা মানে একই জিনিস বারবার করা, মানে একই সংস্কার বারবার উৎপন্ন করা। এভাবে অনেকদিন ধরে অভ্যাস করলে তাদের সম্মিলিত সংস্কার খুব শক্তিশালী হয়, তখন ইচ্ছামাত্রই অবলীলাক্রমে সেই কাজ করা যায়। যে জিনিস আগে খুব মনোযোগ দিয়ে ধরে ধরে করতে হয়েছিল, অভ্যাসের ফলে সংস্কার শক্তিশালী হওয়ায় সেই জিনিসই প্রায় বিনা আয়াসে এবং আরো উন্নতভাবে করা যায়। যেটা কঠিন ছিল সেটা সহজ হয়ে যায়। খুব ইচ্ছাশক্তি দিয়ে করতে করতে শেষে সামান্য ইচ্ছামাত্রই করে ফেলা যায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সংস্কার যদি আরো শক্তিশালী হয়, তাহলে কোনো ইচ্ছা ছাড়াই সেই কর্ম হয়ে পড়ে। যখন এই পর্যায়ে পৌছায়, তখনই একে আমরা বলি অনৈচ্ছিক কর্ম। আমরা বর্তমানে যেগুলোকে দেহ ও মনের অনৈচ্ছিক কর্ম বলছি, সেগুলো একদিনে অনৈচ্ছিক হয়নি। অতীতে কোনো সময় তা ঐচ্ছিকই ছিল; বহুবার ঐচ্ছিকভাবে হবার ফলে সেই কর্ম বর্তমানে অনৈচ্ছিক হয়ে গেছে। কোনো ইচ্ছা ছাড়াই আমাদের দেহ-মন ঐরকম করে থাকে। এরই আর এক নাম সহজাত প্রবৃত্তি (instinct) বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া (reflex)। এখানে অতীত মানে শুধু এই জন্ম নয়, আগের সমস্ত জন্মের কথা বলা হচ্ছে। জন্ম জন্মান্তরব্যাপী অভ্যাসের ফলে বর্তমানে সহজাত হয়ে গেছে। এই হচ্ছে ঐচ্ছিক কর্ম আর অনৈচ্ছিক কর্মের সম্বন্ধ।
এবার আমরা বুঝতে পারব, প্রারব্ধ কর্ম শুধু বিশেষ ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতাই দেয় না, আমাদের দেহ-মনের বিভিন্ন স্বাভাবিক প্রবণতাও প্রারব্ধ কর্মেরই দান। অতীতে সমস্ত জন্মে কৃত সমস্ত কর্ম থেকে যে সমস্ত শক্তিশালী সংস্কার তৈরী হয়েছে, তাই প্রারব্ধ কর্মের মধ্য দিয়ে এই জন্মে দেহ-মনের স্বাভাবিক সাবলীল প্রবণতা হিসাবে প্রকাশ পাচ্ছে। ওপরে আমরা দেহ ও মনের যে সব অনৈচ্ছিক গতির উল্লেখ করেছি, তাদের সবই সংস্কারের জন্য। গভীরভাবে বোঝার জিনিস। আমরা বলি, অভ্যাস হল দ্বিতীয় স্বভাব (habit is the second nature)। কিন্তু বর্তমানে যেটাকে প্রথম স্বভাব বা শুধু স্বভাব বলছি, সেটাও অতীত অভ্যাসেরই ফল। তাই শুধু দ্বিতীয় নয়, দেহ-মনের সমস্ত স্বভাবই অভ্যাসের ফল। আর এটা বুঝলেই বোঝা যাবে, সমস্ত স্বভাবকেই বিপরীত অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা পাল্টাতে পারি। যদি অভ্যাসের ফলেই স্বভাব তৈরী হয়েছে, তাহলে বিপরীত অভ্যাসের মাধ্যমেই তা পাল্টে দেওয়া সম্ভব। বিপরীত অভ্যাসটি ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অভ্যাস করতে হবে। প্রথমে বেশ ইচ্ছাশক্তি লাগবে অর্থাৎ যাকে আমরা বলি খাটতে হবে, কিন্তু করতে করতে বিপরীত সংস্কার যথেষ্ট শক্তিশালী হলে কাজটা সহজ হয়ে যাবে, এবং শেষে একেবারে অনৈচ্ছিকও হয়ে যেতে পারে। তখন সেটাই স্বভাব হয়ে যাবে।
যোগীরা বলেন, আমাদের দেহের ভিতরে যে সমস্ত কার্যকলাপ চলছে – হৃৎপিণ্ড, ফুসুফুস বিশেষ গতিতে চলছে, রক্তচলাচল, বিভিন্ন দেহরসের ক্ষরণ ইত্যাদি – এগুলো সবই আসলে সংস্কারের ফল। এগুলো বর্তমানে অনৈচ্ছিক, কিন্তু যথেষ্ট চেষ্টা করলে এগুলোকেও ঐচ্ছিক করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। যারা দীর্ঘদিন দেহচর্চা করেন তারা জানেন আমাদের দেহে কত সূক্ষ্ম সব পেশি আছে, যাদের সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কোনো ধারণা বা বোধই নেই। অভ্যাসের মাধ্যমে এই সব পেশীকে বোধে এনে ঐচ্ছিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যোগীরা বলেন, হৃৎপিণ্ড যে পেশীর সাহায্যে কাজ করছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের গতিকে পর্যন্ত ঐচ্ছিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অন্যান্য দেহযন্ত্রের সম্বন্ধেও তা সম্ভব। অতএব এক কথায়, দেহ-মনের সমস্ত অনৈচ্ছিক গতিকেই ঐচ্ছিক করা সম্ভব।
রোজ রাত্রে আমরা ঘুমাই। কিছু সময় স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এক সময় স্বপ্নহীন গভীর ঘুমে চলে যাই। এই স্বপ্নহীন গভীর ঘুমকে বলা হয় সুষুপ্তি। রোজকার ভাষায় ঘুম বলতে আমরা স্বপ্ন ও সুষুপ্তিকে একত্রেই বোঝাই। ঘুম থেকে উঠলে স্বপ্নের কথা প্রায়ই মনে থাকে, অল্প বেশি। কিন্তু সুষুপ্তির কথা কিছু মনে আছে কি? কি বলতে পারব তা সম্বন্ধে? কেউ যদি বলে সুষুপ্তিতে কি হয়েছিল, বা কি দেখেছিলি, কিছু বল! কিছু বলতে পারব? – একটাও ইতিবাচক কথা কি মুখ দিয়ে বার করতে পারব ঐ অবস্থার সম্বন্ধে? নাঃ। শুধু নেতিবাচক ভাবে বলতে পারব – ঐ সময়ের কোনো স্মৃতি তো নেই; কিছুই তো দেখিনি, বা শুনিনি; কোনো চিন্তাও তো করিনি; ‘আমি’ এই বোধটা পর্যন্ত ছিল না। কোনো কিছু বলার মতো কোনো ভিত্তিই নেই। অদ্ভুত অবস্থা! কিন্তু তা সত্ত্বেও সুষুপ্তিকে আমরা ভয় করি না। কেন? কারণ হচ্ছে স্মৃতির সংগতি আর নিরবচ্ছিন্নতা। উঠে দেখি সেই একই জগৎ, যেখানে শুয়েছিলাম, যেরম দেহ-মন ছিল, যেরকম জীবন চলছিল, সব মিলে যাচ্ছে। কোনো কিছু উল্টোপাল্টা হয়নি। ঘুমের আগের জগতের সব কিছুর সম্বন্ধের যেরকম স্মৃতি আছে, সেরকমই দেখছি। এবং অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই দেখছি। এরকম জন্ম জন্মান্তর ধরে দেখে আসছি। তাই সেই সংস্কার আছে মনে। তাই সম্পূর্ণ অধরা অবস্থা সত্ত্বেও সুষুপ্তি অবস্থা বিশেষ কিছু আশ্চর্যের বা ভয়ের কিছু নয় আমাদের কাছে, বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক জিনিস। তাই শুধু নয়, অত্যন্ত স্বাভাবিক ভালোবাসার জিনিস। তার কারণ, সুষুপ্তি থেকে উঠে একটা গভীর আনন্দের ও পরিতৃপ্তির রেশ বোধ হয়, যেটা কোনোদিন সুষুপ্তি না হলে বোধ হয়না; তাছাড়া সুষুপ্তির মাধ্যমে দেহ-মনের কষ্ট যেভাবে দূর হয়, তা অন্য কিছুর মাধ্যমে হয়না। জগতের সমস্ত কিছু বিস্বাদ লাগলেও তাই সুষুপ্তি বা গভীর ঘুমকে কখনই বিস্বাদ লাগেনা। অনেকে দুঃস্বপ্ন দেখে বলে ঘুমোতে ভয় পায়, বা ঘুমের মধ্যে চলাফেরা করে বলে (somnambulist) ঘুমোতে ভয় পায়। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে সেটা গভীর ঘুমকে ভয় নয়, স্বপ্ন অবস্থাকে ভয়, কিংবা ঘুমন্ত অবস্থায় চলাফেরা করে নিজের বা অন্যের ক্ষতি করতে পারে সেই আশঙ্কাকে ভয়। সুষুপ্তিকে কেউ ভয় পায় বলে মনে হয়না।
কিন্তু এবারে মৃত্যুর কথা চিন্তা করা যাক। মৃত্যুকে আমরা ভয় পাই। কারণ, প্রথমতঃ আমাদের এমন কোনো স্মৃতি নেই যেখানে মৃত্যুর আগের ও পরের কথা আমাদের মনে আছে। সুষুপ্তি অবস্থা ও মৃত্যু অবস্থা এই দুয়েরই কোনো সরাসরি স্মৃতি না থাকলেও, সুষুপ্তির আগের ও পরের অবস্থার স্মৃতি আছে। কিন্তু মৃত্যুর আগের ও পরের স্মৃতি নেই। দ্বিতীয়তঃ আমরা কাউকেই দেখি না যে মৃত্যুর পরেও আবার জেগে উঠেছে। বরং দেখি একবার মৃত্যু হলে দেহটা নষ্ট হয়ে যায়। এই রকমই দেখে অসছি জন্ম জন্মান্তর ধরে। তাই সেই সংস্কার বদ্ধমূল। তাই মৃত্যুকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই ভয় করি কারণ মনে করি মৃত্যুতে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, আর থাকবো না।
কিন্তু আগেই দেখেছি, মনে আছে কি নেই তার ওপর কোনো ঘটনা নির্ভর করে না। পুনর্জন্মবাদ বলছে আগে আমাদের বহুবার মৃত্যু হয়েছে এবং বহুবার জন্মও হয়েছে। কিন্তু এক জন্মের স্মৃতি তার পরের জন্মের সচেতন মনে থাকে না বলে আমাদের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়। তবে বিভিন্ন লোকের দেহ-মনের বিভিন্ন প্রবণতা লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে ব্যাপারটা বিশ্বাস করা যথেষ্টই সহজ।
প্রথমেই মনে করে নেওয়া যাক, কর্ম ও কর্মজনিত অভিজ্ঞতা প্রত্যেকের নিজস্ব। একজনের কর্মে আর একজনের অভিজ্ঞতা হতে পারে না। বাইরে কি দেখছি, তা দিয়ে কর্মের বিচার হয় না। বাইরে, অবশ্যই কোনো কিছুর মাধ্যমেই অভিজ্ঞতা আসবে, কিন্তু অভিজ্ঞতাটা যে আসবে, এটা নিজের কর্মের জন্যই। আরো মনে করে নেওয়া যাক যে প্রারব্ধ কর্মের ফললাভের উপযোগী হিসাবেই পরবর্তী জন্মের দেহ-মন-আয়ু-পরিবেশ-পরিস্থিতি গঠিত হয়।
পুনর্জন্মবাদ অনুসারে বিভিন্ন জন্মে আমাদের দেহ-মন-আয়ু-পরিবেশ-পরিস্থিতি একই রকম হবে না। দেহ একই হবে না, অর্থাৎ কোনো জন্মে হয়তো পুরুষ দেহ, কোনো জন্মে নারী দেহ। মন একই হবে না– কোন জন্মে মনের একদিকে প্রবণতা, অন্য জন্মে আর এক দিকে প্রবণতা। আয়ুও বিভিন্ন হবে– কোনো জন্মে খুব কম বয়সেই মৃত্যু হয়েছে, কোনো জন্মে হয়তো যথেষ্ট বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি আলাদা– কোনো জন্মে হয়তো স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম হয়েছে, কোনো জন্মে আবার গরীব পরিবারে জন্ম হয়েছে। তাই শুধু নয়, এক জন্মে এক বাবা-মা-ভাই-বোন, অন্য জন্মে অন্য বাবা-মা-ভাই-বোন। কিংবা এক জন্মে যে আমার ছেলে, পরের জন্মে সে হয়তো আমার বাবা কিংবা অন্য কোনো আত্মীয়। হতেই পারে। এক জন্মে যে কারোর স্বামী বা স্ত্রী, অন্য জন্মে সে অন্য কারোর স্বামী বা স্ত্রী। অর্থাৎ এক কথায় জগতের কারোর সঙ্গে স্থির সম্পর্ক বলে কিছু নেই। অবশ্য এটা স্বীকার করা হয় যে এক জন্মে দুজন কাছাকাছি মানুষের কর্ম যদি যথেষ্ট পরস্পর-সম্বদ্ধ হয়, তাহলে পরের জন্মেও তাদের কাছাকাছি সম্পর্ক হতে পারে, একই পরিবারেও হতে পারে। কিন্তু সম্পর্ক ঠিক কীরকম হবে, মা-বাবা, না কি প্রতিবেশী, না কি ভাই-বোন, না কি অন্য কিছু, তা স্থির নয়। পুনর্জন্মের বোধকে এভাবে বিস্তৃত ভাবে ভেবে দেখলে দেখতে পাব যে, জগতের সবাই যেন আমার সমানভাবে আপন। পূর্বের কতো কতো জন্মে কতো কতো বিভিন্ন মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয়-প্রতিবেশী আমরা পেয়েছি। একটা নির্দিষ্ট জন্মের সম্পর্ক কোনো বিশেষ সম্পর্ক নয়। সে তুলনায় বিভিন্ন জন্মের মধ্যে দিয়ে সমগ্র জগৎ-জীবনের যে আন্তঃসম্পর্ক, তা বরং অধিক অর্থবহ। একটা নির্দিষ্ট জীবনের সম্পর্ক ক্ষুদ্রতর সত্য, বহু জীবনের সম্পর্ক বৃহত্তর সত্য। এটা ধারণা হলেই আমরা বুঝতে পারব কেন সংকল্পের মাপকাঠি সার্বজনীনত্ব – যেটা আগে বলা হয়েছে। যার সংকল্প যতো স্বার্থপর বা ক্ষুদ্র, সে ততো বেশি একটা নির্দিষ্ট জন্মকেন্দ্রিক। অন্যদিকে যার সংকল্প যতো নিঃস্বার্থ, সার্বজনীন বা সার্বভৌমিক, সে ততো বেশি বৃহত্তর সত্যের কাছাকাছি, তাই তার সংকল্প ততো উচ্চ।
পুনর্জন্মের কথা গভীর ভাবে চিন্তা করলে আমরা আরো দেখতে পাবো, আমরা যে জীবনটা যাপন করছি, তার মূল্য কি, বা তার উদ্দেশ্য কি, বা তার পরিণতিটাই বা কি। এই জন্মে আমরা যা যা করছি, যেভাবে রোজ ঘুম থেকে উঠছি, যেভাবে ভালো-মন্দ খাবার খাচ্ছি, যেভাবে বিভিন্ন জিনিস উপভোগ করছি – এসব কিছুই বহু বহু বার আমরা আগে করে এসেছি। বাচ্চা বয়স থেকে শুরু করে এরকমই বহু বহু বার আমরা যুবক হয়েছি, প্রৌঢ় হয়েছি, বৃদ্ধ হয়েছি, তারপর দেহত্যাগ করেছি। জীবনে যে ছোটো-বড়ো সুখ-দুঃখের ঘটনা ঘটছে এখন, এরকমই কতো কতো জন্মে কতো কতো বার কতো কতো ভাবে ঘটে গেছে। যেসব ঘটনাকে জীবনে বিশেষ বলে ভাবছি, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে কিছুই বিশেষ নয়, বহুবার ঘটে গেছে আগে। কেউ যদি জীবনে আঘাত পায়, যদি কষ্টকর অভিজ্ঞতা আসে, যদি মনে হয় জীবন দুর্বিসহ বা অর্থহীন, তখনই ভেবে দেখার যে এই জন্মের এই আঘাত আর কি, পূর্বের কতো কতো জন্মে কতো কতো এরকম আঘাত আমরা সয়ে পার করে এসেছি, সে সব কিছুর পরেও আমাদের অস্তিত্ব একইরকম অনড়, কোনো কিছুই আমাদের সত্তাকে ধ্বংস করতে পারে নি, এবং পারবেও না। স্থূল শরীরের দোষ-গুণ বিভিন্ন জন্মে বিভিন্ন হবে সন্দেহ নেই, বিভিন্ন মানসিক ক্ষমতাও বিভিন্ন জন্মে বিভিন্ন হবে। কিন্তু এই সমস্ত বিভিন্নতার পেছনে কোথাও যেন একটা স্থির জিনিস আছে; সেই স্থির জিনিসটাই আমাদের সত্তা, যেটা অপরিবর্তনীয়। সেই সত্তা বিভিন্ন দেহ-মনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জন্মে প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু নিজে সে সমস্ত বিভিন্নতার পশ্চাতে ধ্রুব শাশ্বত চির-সুরক্ষিত। শরীর-মনের চরমতম দুরবস্থাতেও সেই সত্তায় বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন হয়না। মৃত্যুতে কি হয়? শরীরটা শুধুমাত্র চলে যায়, কারণ সমস্ত সংস্কার-সমেত মন শরীর থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নেয়। আবার সেই মন যখন অন্য একটা শরীরে নিজেকে যুক্ত করে, তখন তাকে বলি পুনর্জন্ম। সেই শরীরেরও মৃত্যু হলে, মন সে পর্যন্ত সঞ্চিত সংস্কার নিয়ে আবার আর এক শরীরে যায়। অতএব দেখছি, মৃত্যুতে শরীর যেভাবে ধ্বংস হয়, মন সেভাবে ধ্বংস হয় না; মনের সংস্কার রাশি শুধু ক্রমপরিবর্তিত (updated) হয়। আর মনেরও পশ্চাতে আছে আমাদের প্রকৃত সত্তা, যা সমস্ত পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে। শুধু এক জন্ম কি দশ জন্মে নয়, কোটি জন্মে দেহ-মনে চরমতম কষ্ট পেলেও আমাদের সত্তায় কণামাত্রও কোনো প্রভাব পড়বে না। পুনর্জন্মের কথা ভেবে দেখলে, তাই কি হয়ে আসছে না? কতোবার আমাদের মৃত্যু হয়েছে মানেই কতো কতো বার কতো কতো ভাবে আমরা মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছি, তাতে কি আমাদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে গেছে? গেলে এই কথাটি কে পড়ছে? যায়নি। আবার অন্যদিকে, যে মানুষকে বা যে জিনিসকে স্থূলভাবে আমার বলে ভাবছি, তা বড়জোর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত থাকবে, তারপর আমার বর্তমান স্থূল শরীরের সাথে তার স্থূল শরীরের আর কোনো সম্পর্কই থাকবে না। পরের জন্মে তার কথা মনেও থাকবে না। এরকমই কত কত বার হয়ে এসেছে আগের বিভিন্ন জন্মে। স্থূল জগতের যা কিছু, বাড়ি ঘর দোর আত্মীয় স্বজন সম্পত্তি লোকবল অর্থবল নাম যশ খ্যাতি – এর কোনো কিছুই মৃত্যুর পর যাবে না। যদি যেত তাহলে আগের বহু বহু জন্মের সুবাদে আমাদের এই জন্মে অগুণতি বাড়ি অর্থ নাম যশ হত। কি যাবে মৃত্যুর পর? স্থূলভাবে কিছুই যায় না, শুধু সূক্ষ্মরূপে সংস্কার হিসেবে যায়, যাকে বলি কর্ম।
পুনর্জন্মের বোধকে এভাবে যত গভীরভাবে বোধ করা যাবে, ততো জীবনের পরিবর্তনশীল জিনিসের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ কমে যাবে, অর্থাৎ ক্ষুদ্রতর জীবনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে, কারণ তার পশ্চাতে এক বৃহত্তর জীবনের আভাস ও আস্বাদ পাওয়া যাবে। ক্ষুদ্রতর সুখ ও দুঃখ, ক্ষুদ্রতর চাওয়া ও পাওয়া – এসবই অকিঞ্চিৎকর মনে হবে। জন্ম-জন্মান্তরের পরিবর্তনের মাঝে যা অপরিবর্তনীয়, অর্থাৎ যা সমস্ত পরিবর্তনের উর্ধ্বে – এবং যা আমাদের প্রকৃত সত্তা – তার দিকে যাওয়াই জীবনের বৃহত্তম অর্থ বলে মনে হবে। তার চেয়ে বৃহত্তর জীবনের আর কোনো অর্থ কি থাকতে পারে!